বাংলা ভাষা - টিকে থাকা বা না থাকার খতিয়ান , প্রেক্ষাপট- অধুনা ২০২৩
বাংলা ভাষা - টিকে থাকা বা না থাকার খতিয়ান , প্রেক্ষাপট- অধুনা ২০২৩
আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং সর্বোপরি আজকের বাংগালির বাংগালি হয়ে উঠার জন্য লিখিত দলিল পাওয়ার দিবস।
আজ যদি ১৯৫২ না হত,কিংবা বাংলা আমাদের মাতৃভাষা না হত, আমি কি বাংলা ভাষা জান্তাম না, কিংবা আমার সন্তান কি বাংলা শিখত না? শিখত! জানত, বলতো! কিন্তু আমাদের যুদ্ধ ছিল, জোর করে আমাদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে! সেটাতে জয়ী হয়ে এসেছি! আমাদের অফিসিয়াল ভাষা এখন বাংলা।
আমার ভাষা অনেকগুলো -
আমি চলিত ও সাধু রুপে - সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি।
আমি ইন্দো ইউরোপীন গ্রুপের একটা সাব ভাষা- নোয়াখাইল্লা ভাষায় কথা বলতে পারি একদম সহীহ শুদ্ধভাবে, এটা আমার মাতৃভাষা সত্যিকার অর্থে।
আমি কলোনিয়াল দের ভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা- ইংরেজিতে কথা বলতে পারি।
আমি বৈবাহিক এবং অবস্থান সুত্রে দুনিয়ার অন্যতম ১০০ ভাষার একটা চাটগাইয়া ভাষায় কথা বলতে পারি পুরোদমে।
আমি চাকুরিসূত্রে চায়নাতে অবস্থান করার কারনে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ভাষাভাষীদের ভাষা ট্রেডিশনাল মান্দারিন ভাষা বুঝি এবং ভাব বা কাজ চালানোর মত কথা বলতে পারি।
হিন্দি, উর্দু - পুরোদমে না পারলেও কাজ চালানোর মত পারি বলেই মনে হয়।
এত কিছুর পরেও, বাংলা ভাষা আমার মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা! এই ভাষায় কথা বলার মজাই আলাদা, মনে হয় প্রাণ খুলে কথা বলছি! এই যে আবেগ, এটা আবার লজিক দিয়ে চলেনা! সালাম রফিক বরকত দের রক্ত বৃথা যায়নায়!
আবার আমার বৃদ্ধা দাদির সামনে কেউ এখন শুদ্ধ বাংলা মানে প্রমিত বাংলায় কথা বললে সেটার এক বিন্দু ও কেউ বুঝবেনা, সবচেয়ে মজা লাগে আমার দাদী আর বউ যখন আলাপ করতে বসে, কেউ কারোটা বুঝতনা, সাবটাইটেল হিসেবে আমাকে লাগত কিংবা আমি আর আমার দাদী/নানী শাশুড়ির আলাপে আমার বউকে লাগত সাব টাইটেল হিসেবে কাজ করার জন্য। ( এখন অবশ্য ঠিক হয়ে গেছে এক দশকের প্রেক্টিসে সবার )
আসলে আমরা যতটা না বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করেছি, তার চেয়ে বেশি লড়াই করেছিলাম নিজের ভাষার জন্য!
আজ যদি ১৯৫২ সালে জিন্নাহ এসে বলত- ইংরেজিই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং বাংলা, উর্দু, পশতু সহ বাকি সকল ভাষা উপভাষা কিংবা লোকাল ভাষা হিসেবে ইংরেজির পাশাপাশি চালু থাকবে তাহলে কোন যুদ্ধ ও হত না কোন আলাপ ও আসত না। জিন্নাহ্'র প্যান ইসলামিক পলিটিক্স এবং তার অখন্ড ইসলামিক রাষ্ট্র করার ভাবনা থেকে গুজারাটি মাতৃভাষার ইংরেজি বলুয়া জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিল বাংলা ভাষাকে দমন করার।
যাইহোক, আসল আলাপে ফিরি।
বাংলার ভবিষ্যৎ কি? ভাষা একটা প্রবাহমান নদীর মত, চলতে থাকে আর আশে পাশে খাল নালা নদীর মত ছুতো পেলেই পালিয়ে যেতে যায়! আসলে এই কারনেই সেই গুহা জীবন থেকে যে ইশারা ভাষার শুরু সেটা থেকে আজকের এই পরিপূর্ন আলাদা আলাদা ভাষা! তবে সে গতিপথ কি থেমে গেছে? নাকি বিবর্তন বন্ধ হয়েছে?
একটু বই পত্র চেক করলেও বুঝা যাওয়ার কথা। বংকিম , জীবন বাবু, রবীন্দ্রনাথ রা নিজেদের মত করে ভাষা এগিয়ে নিয়েছেন আর বাকিরা নিজেদের মত সেটা গ্রহন করেছে। আজ থেকে ১০০ বছর আগের একটা বই খুলে বসলে মাথা নস্ট হবার মত অবস্থা-
হিন্দু জমিদার দের অত্যাচারে অতিষ্ট মোছলেমরা মছুয়া বাংগালি থেকে সহীহ ও আশরাফ বাংগালি হবার খাসলে যে পাকিস্তানকে আকড়ে ধরেছিল, তাহার বন্দোবস্ত জিন্নাহ সাহেব পরিপুর্ন না করেই একটা দ্বিজাতিতত্ত্বের মত দ্বিখন্ডিত শ্রেণি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা করে মূলত মছুয়া বাংগালি মোছলেমদের কপালে আঘাত করলেন।
এই লেখা আজকে কোন লেখক লিখলে - শুধু অন্তত লিখার ভাষার জন্য রাষ্ট্র বা সরকার থেকে মামলা খাবেন কয়েক ডজন আর ঘাড়ের উপর থেকে মাথা যাওয়ার ভয় থাকবে এক্সট্রিমিস্ট দের অপমান করার অজুহাতে।
আবার বংকিম এর বাংলা এখন উচ্চশিক্ষিত মাস্টার্স পাস কাউকে পড়তে দিলে মুহুর্তে বেহুশ হবে এমন ও অনেক আছে।
তাই আজকাল যখন রাবা খান কিংবা জেনারেশান স্মার্টদের প্রতিনিধি সাল্মান মুক্তাদির রা যখন নিজেদের মত করে বাংলা লিখেন, তখন হায় হায় করে যতই রব উঠাই না কেন, এটাই আসলে ভাষার নিয়তি।
আজ থেকে ১০০ বছর পর বানান আন্দোলন কিংবা বাংলা একাডেমি কিংবা প্রথম আলোর মত ভাষা ব্যাকরন ঠিক করার প্রয়োজনীয়তা পরবেনা। মানুষ নিজের মতই ভাষা ঠিক করে নিবে।
আমরা কলিকাতা - ঢাকা বাংলায় যে তফাত দেখি কিংবা অনন্দবাজার-প্রথম আলোর যে যুদ্ধ এটা আসলে সময় আর অঞ্চলের প্রয়োজনেই!
স্পেশালি ফেসবুক জেনারেশান বাংলা ভাষার ভার্জিনিটি নস্ট করেছে আর সময়ের প্রয়োজন এটাকে নিয়ে যাবে বহুধা ধারায়।
এই কারনে যখন আইমু যাইমু খামু কিংবা এইত আছি চলতাছে আর কি কোন রকম ফেসবুক থেকে বের হয়ে বইয়ের ভেতর ঢুকে যাবে তখন আবার রই রই করে উঠলেও লাভ নেই!
আমাদের বাংলা ভাষা বিবর্তনের ধারায় এখন উতকর্ষের দিক থেকে অবমননের দিকে চলেছে। এই অবনমন আবার সময়ের দাবি, এটা হয়েই আসছে! এখন এটা রোখার আমাদের সাধ্য নেই! আমাদের উচিত- সময়ের সাথে তাল মিলানো!
সবাইকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা!


