কেন মহাকাশ গবেষণা ? ( “Why Explore Space?” )
১৯৬০ এর দশক, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা'র মাঝে স্পেস এক্সপ্লোরেশান তথা মহাকাশ দৌড় চলছে তুমুল বেগে। এমন অবস্থায় নাসা একটা যুগান্তকারী প্রজেক্ট হাতে নেয়- যার নাম ছিল Nuclear Engine for Rocket Vehicle Application বা সংক্ষেপে NERVA
এই প্রজেক্ট ছিলো- ক্যামিকেল প্রপালশান সিস্টেমের পরিবর্তে একটা নিউক্লিয়ার প্রপালসান নিয়ে কাজ করা যা পরবর্তী মংগল মিশনে ব্যবহার করা যাবে। এটার মুল ডিজাইন করেছিলেন Marshall Space Flight Center (MSFC) এর একদল বিজ্ঞানী এবং তাদের লিডার ছিলেন জার্মান- আমেরিকান বিজ্ঞানী আর্নস্ট স্টুডলিংগার ( Ernst Stuhlinger )
তাদের এই মাল্টি-বিলিয়ন ডলার প্রজেক্ট এর খরচের বাহার দেখে, সুদূর আফ্রিকার জাম্বিয়া নামক অচেনা একটা দেশের মেরি জাকুন্ডা ( Mary Jucunda ) নামক চার্চের এক নান চিঠি লিখেছিলেন আর্নস্ট স্টুডলিংগার কে। সেই চিঠিতে মেরি জানতে চেয়েছিলেন-
" যখন দুনিয়ার অনেক প্রান্তরে লাখো কোটি শিশু ক্ষুধার যন্ত্রনায় কাতর হয়ে ঘুমোতে যায়, তখন মহাকাশ গবেষণার এই ধরনের একটা প্রজেক্টে বিলিয়ন ডলারের মত ব্যয় করা কতটুকু যৌক্তিক ? "
আর্নস্ট সেই চিঠির উত্তরে লিখলেন জগৎবিখ্যাত আরেকটি চিঠি। নীচে সেই চিঠিটির বাংলা অনুবাদ দেয়া হল-
কেন মহাকাশ গবেষণা ? ( “Why Explore Space?” )
৬ ই মে, ১৯৭০
প্রিয় সিস্টার মেরি জাকুন্ডা,
তোমার চিঠির মত প্রতিদিন আমার কাছে শত শত চিঠি আসে। কিন্তু তোমার চিঠিটি আমাকে সবচেয়ে বেশী আন্দোলিত করেছে এই বোধ থেকে যে, তুমি তোমার মনের সৎচিন্তা এবং নির্মোহ হৃদয় থেকে জানতে চেয়েছ কিছু প্রশ্নের উত্তর। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেস্টা করব তোমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার।
প্রথমত, আমি তোমাকে সহ তোমার সমমনা বাকি সিস্টার দের ধন্যবাদ জানাতে চাই । দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্র কাজটা করার জন্য তোমরা তোমাদের জীবন উতসর্গ করছো আর তা হলো- অসহায় নিপীড়িত মানুষ কে সাহায্য করা যাদের সাহায্য করার জন্য কেউ নেই।
তুমি তোমার চিঠিতে জানতে চেয়েছ আমি কিভাবে সুদূর মংগলে একটা মিশন পরিচালনা করার জন্য বিলিয়ন ডলার ব্যায় করতে চাচ্ছি যেখানে এই মাটির পৃথিবীতে অনেক শিশুই ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। আমি জানি তুমি আমার কাছ থেকে এই উত্তর আশা করছ না - " ও আমি আসলেই জানতাম না, এমন অবস্থা। এখন থেকে আমি দুনিয়ার সকল শিশুর ক্ষুধা দূর করার আগে, কোন ভাবেই এমন খরুচে মহাকাশ মিশনের পরিকল্পনা আর করবোনা । "
বরং, আমি দুনিয়ার বুকে এমন একটা মনুষ্যবাহী মংগল যাত্রা প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব এটা বিশ্বাস করার আগেই ক্ষুধায় কাতর শিশুদের দেখা পেয়েছিলাম।
যাই হোক, আমার অনেক প্রতিযশষা বিজ্ঞানী বন্ধুদের মতই আমিও বিশ্বাস করি, চাঁদের পাশাপাশি মংগল সহ আরো দূরের গ্রহ উপগ্রহে যাত্রার জন্য এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
আমি বিশ্বাস করি এইসব বিশাল প্রযুক্তির প্রজেক্টগুলো আমাদের দুনিয়ার বুকে অনেক মারাত্মক সমস্যার সমাধান করতে লম্বা সময় ধরে সাহায্য করবে অনেক খরুচে প্রজেক্টের চেয়ে ভাল্ভাবে যেগুলা নিয়ে বছরের পর বছর আলোচনা , তর্ক বিতর্ক হয়েছে এবং সেই খরুচে প্রজেক্টগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিশীল ফল পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ এবং অনেক মন্থরগতির।
কিভাবে আমাদের মহাকাশ গবেষণা দুনিয়ার বুকে অনেক সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করবে সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমি তোমাকে একটা সত্য ঘটনার মুখোমুখি করতে চাই, যা হয়ত আমার যুক্তিকে আরো শক্ত করবে।
আজ থেকে ৪০০ বছর আগে জার্মানির একটা ছোট্ট শহরে একজন সৎ এবং রাজকীয় ভদ্রলোক বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানবিক মানুষ যিনি তার আয়ের সিংহভাগ বিলিয়ে দিতেন শহরের অভাবীদের মাঝে। তখন উনার এই কাজ ছিল চমৎকার সততা এবং মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ কারন গ্রেট প্লেগের কারনে মধ্যযুগের সেই সময়ে বিরাজ করছিল চরম অসহায়ত্ব ।
একদিন এই মানবিক ভদ্রলোক এক অদ্ভুত লোকের সন্ধান পেলেন। অদ্ভুত লোকটি একটা ছোট্ট টেবিলের মত যায়গায় আরো ততোধিক ছোট একটা গবেষণাগার তৈরি করে নিয়েছিলেন। আর তার গবেষণাগারে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক ঘন্টা কাজ করার জন্য পুরো দিন প্রচুর পরিশ্রম করতেন নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে। ক্ষ্যাপাটে গবেষকটি কাচ থেকে কেটে কেটে ছোট ছোট লেন্স তৈরি করতেন এবং সেটা দিয়ে ছোট ছোট ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিষ দেখার চেষ্টা করতেন।
আমাদের মানবিক ভদ্রলোক একটা সাধারণ কাচ কে ব্যবহার করে এই ছোট ছোট জীবানু কিংবা চোখের আড়ালে থাকা জীবন দেখতে পেয়ে খুবই অতিভূত হলেন। তিনি সেই অদ্ভুত সখের গবেষক কে আমন্ত্রন জানালেন তার বাড়িতে এবং পুরো গবেষণাগার স্থানান্তর করলেন তার প্রাসাদে। সেই সাথে গবেষক কে তার প্রাসাদে বেতনভুক্ত কর্মচারী করে নিলেন, যাতে আমাদের গবেষক তার কাজের পুরো সময়টা গবেষণার কাজে ব্যায় করতে পারেন এবং উনার সেই অদ্ভুত যন্ত্রটিকে আরো পরিপূর্ন করতে।
শহরের লোকজন এটা জেনে গেল অল্প দিনেই, এবং তারা এই বলে প্রতিবাদ করতে লাগলো, আমাদের দানবীর ভদ্রলোক উনার টাকা নস্ট করছেন। তারা বলতে লাগলো- " আমরা প্লেগে মরছি, আর উনি এক খেপাটে পাগলার পেছনে টাকা উড়াচ্ছেন ঐ পাগলের সখের জন্য । "
কিন্তু আমাদের মানবিক মানুষ টা চুপ রইলেন এবং প্রতিউত্তরে বললেন, " আমি তোমাদের জন্য যা করছি এটাই আমার সর্বোচ্চ এবং আমি যা আমার সাধ্যের মধ্যে করতে পারি তাই করেছি ", তিনি আরো বলেন, "সেই সাথে আমি এই পাগলা গবেষক এবং তার কাজকে সাহায্য করে যাব কারন আমি বিশ্বাস করি একদিন দুনিয়াবিখ্যত কিছু করা সম্ভব এই কাজের দ্বারা "
এবং অবশ্যই দুনিয়াবিখ্যত কিছু একটা হয়েছিল। সেই পাগলা গবেষক সহ সমকালীন আরো অনেক বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় আবিস্কার হয়েছিল মাইক্রোস্কোপ নামক এক যন্ত্র!
এটা একটা সর্বজনবিদিত সত্য যে মানব সভ্যতায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিল এই মাইক্রোস্কোপই এবং প্লেগ সহ অন্য আরো সংক্রামক ব্যাধি দুনিয়া থেকে বিদায় করতে মাইক্রোস্কোপিক গবেষণা বিরাট কাজে লেগেছিল।
আমাদের জার্মানির সেই দানবীর ভদ্রলোক তার আয়ের অল্প কিছু ব্যয় করেছিলেন রিসার্চ এবং গবেষণার পিছনে । উনি যদি উনার জীবনের সমগ্র উপার্জন তৎকালীন প্লেগ পীড়িত জনগনের পেছনে খরচ করতেন তাতেও বড় আকারে দুর্ভোগ লাঘব হতনা, বরং তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী কাজে দিয়েছিল উনার সেই পাগলাটে বিজ্ঞানীর পেছনে অল্প ব্যায় ।
আমাদের বর্তমান অবস্থা অনেকটা এই রকম। এই মুহুর্তে ২০০ বিলিয়ন ডলার বাজেট ব্যায় করছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট এক বছরে। এই বাজেট একাধারে স্বাস্থ্য , শিক্ষা, গরীবদের দেখভাল, গ্রামীন ও শহুরে উন্নয়ন, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ, যাতায়ত, বৈদেশিক সাহায্য, প্রতিরক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, কৃষি এবং অনেক অনেক যায়গায় খরচ হয় দেশ এবং দেশের বাইরে। এই বছর মাত্র ১.৬ % বাজেট এই মুহুর্তে সরকার ব্যায় করছে মহাকাশ গবেষণায়। আমাদের মহাকাশ বাজেটের মধ্যে রয়েছে এপোলো প্রজেক্ট, স্পেস ফিজিক্স প্রজেক্ট, স্পেস বায়োলজি সহ দূর গ্রহ অনুসন্ধানের জন্য প্লানেটরি সায়েন্স প্রজেক্ট।
আমরা যদি একটা গড় হিসাব টানি, একজন সাধারণ আমেরিকান যদি বছরে ১০,০০০ ডলার উপার্জন করেন, তিনি মাত্র ৩০ ডলার ট্যাক্স হিসেবে দিচ্ছেন মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণায়। তার বাকি ৯,৯৭০ ডলার থাকছে তার কাছে, যেটা দিয়ে তার সকল খরচ, তার বাকি ট্যাক্স, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং সঞ্চয় হিসেবে জমা থাকছে।
তুমি হয়ত প্রশ্ন করতে পারো, " তাহলে কেন আমরা আমেরিকান ট্যাক্সদাতাদের ঐ ৩০ ডলার থেকে ১/২ অথবা ৫ ডলার নিচ্ছিনা এবং সেটা ক্ষুধা নিপীড়িত শিশুদের পাঠাচ্ছিনা? "
এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আমাকে প্রথম ব্যাখ্যা করতে হবে কিভাবে অর্থনীতি কাজ করে। দুনিয়ার সকল দেশের জন্যই এই ধারা একই রকম। সরকার অনেকগুলো মন্ত্রনালয় নিয়ে কাজ করে, যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য , আইন ও বিচার, যাতায়ত, প্রতিরক্ষা সহ অন্যান্য এবং বিভিন্ন বিভাগ যেমন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশান বা নাসা ( National Aeronautics and Space Administration ) । প্রতিটা সরকারি মন্ত্রনালয় এবং বিভাগ থেকে তাদের বাৎসরিক বাজেট চাওয়া হয়। প্রতিটা বিভাগ আলাদা আলাদা ভাবে তাদের বাজেট কে ডিফেন্ড করে এবং মারাত্মক চাপের মাঝে তারা যদি প্রেসিডেন্ট এবং বাজেটের কংগ্রেসনাল কমিটিকে বুঝাতে পারে তাদের চাওয়া যৌক্তিক তবেই তাদের বাজেট পাশ হয়।
এবং সেই পাশ হওয়া বাজেট থেকে তারা শুধুমাত্র আগে থেকে উল্লেখ করে রাখা এবং কংগ্রেসনাল কমিটি থেকে অনুমতি পাওয়া ক্ষেত্রেই টাকা খরচ করতে পারে।
এখন প্রশ্ন করতে পারো, আমাকে যদি বলা হয় আমার ট্যাক্সের সাথে আরো ১/২/৫ ডলার করে যোগ করে সেটা ক্ষুধার্ত শিশুর মাঝে বিলিয়ে দিলে আমার মত কি? আমি সহ আমার সকল বিজ্ঞানী বন্ধুরাই এই মর্মে একমত হবে বলে ধারনা করছি।
তবে কস্টের কথা হল, এই ধরণের কোন একটা প্রোগ্রাম আমরা শুধুমাত্র মংগলে যাত্রার মিশন ক্যান্সেল করেই সফল করে ফেলতে পারব এমন ভাবলে সেটা ভুল হবে। বরং আমি মনে করি মহাকাশ গবেষণার মাধ্যমে আমি আরো বেশী অবদান রাখতে পারব এই ক্ষেত্রে। দুনিয়া ব্যাপি হাংগার সমস্যার দুইটা ভাগ- খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য বন্টন।
দেখা যায়- দুনিয়ার কোন প্রান্তে কৃষি কাজ, পশু পালন , মাছ চাষ সহ বিরাট আকারের কৃষির জন্য উপযুক্ত আবার কোন অঞ্চল উপযুক্ত নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- অনেক বিরাট একটা অঞ্চল জুড়ে যথাযথ কৃষিচাষ নিশ্চিত করা যায় যদি সঠিক পানি ও সেচ বন্টন, সার ব্যবহার, আবহাওয়া পূর্বাভাস, জমির উর্বরতা নির্ধারণ, বীজ বপনের উপযুক্ততা নির্ধারণ , জমি বাছাই , ফসল ফলানোর সঠিক সময় জানা, ফসল সার্ভে সহ উন্নত মানের কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
আর উপরের এই সকল ব্যাপার গুলো সঠিক ভাবে করার একমাত্র সমাধান হল কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক পৃথিবীর উপর ঘুরতে থাকা কৃত্তিম উপগ্রহ। পৃথিবীর উপর দিয়ে হাজার মাইল উপর থেকে ঘুরতে থাকা অবস্থায় এটি বিরাট জমিন চেক করতে পারবে, নজরে রাখতে পারবে ফসল, মাটি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বরফ পড়া সহ আরো অনেক গুলো কৃষি বিষয়ক ঘটনা এবং সেই কৃত্তিম উপগ্রহ সাথে সাথে ইনফরমেশান এবং ডেটা পাঠিয়ে দিতে পারবে পৃথিবীতে । এক গবেষণায় দেখা গেছে, যদি সঠিক সেন্সর, যন্ত্রপাতি সহ একটা কৃত্তিম উপগ্রহ ভিত্তিক দুনিয়াব্যাপি কৃষি গবেষণা প্রজেক্ট নেয়া যায়, সেটা পুরো দুনিয়ার ফসল উৎপাদন বাড়াতে পারে কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের বেশী।
অন্যদিকে খাদ্য বন্টন আরেক ভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং সেটার সমাধান ও করতে হবে ভিন্ন ভাবে। এটা শুধুমাত্র বিরাট ট্রান্সপোর্ট ইসুনা, এটা পুরা দুনিয়াব্যাপি অপারেশান এবং সমাধান করতে হবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে । কোন একটা ছোট্ট দেশ অন্য কোন এক বিরাট রাষ্ট্রের বিশাল খাদ্য সহায়তা পাওয়ার সাথে সাথে ভয়ে থাকবে এই বুঝি খাবারের সাথে ছোট দেশকে সাহায্যদাতা বড় দেশ তাদের দাস বানানোর প্রকৃয়া শুরু করে দিলো।
এই দুনিয়াব্যপী ক্ষুধা নির্মূল; রাষ্ট্রগুলোর মাঝখানে হিংসা, ভয় আর প্রতিযোগীতার দেয়াল যদি না ভাংগা যায় কখনোই সম্ভব হবেনা। আমি মনে করিনা, কোন এক স্পেস ফ্লাইট একদিনেই এই সমস্যা সমাধান করে ফেলবে। তবে মহাকাশ গবেষণা প্রোগ্রাম এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল এবং আশাবাদি প্রকল্প এই বাধা দূর করতে।
মনে করিয়ে দিতে চাই এই ক'দিন আগে আমাদের Apollo 13 মিশনের প্রায় হতে চলা ট্রেজেডির কথা। যখনি মহাকাশ থেকে আমাদের এট্মোস্ফিয়ারে Apollo 13 রি-এন্ট্রি নেবার সময় হলো- তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সকল ধরনের রাশিয়ান রেডিও ট্রান্সমিশান অফ করে দেয় যাতে করে নভোযানের সাথে আমাদের হিউস্টনের যোগাযোগে কোন ধরনের বাধা না আসে। এমনকি রাশিয়ান রেস্কিউ শিপ গুলোকে প্যাসিফিক আর আটলান্টিকে পাঠিয়ে দেয় তারা যদি আমেরিকান নভোযানের ইমারজেন্সি রেস্কিউ করার দরকার হয়। এমন যদি হত নভোচারীদের ক্যাপ্সুল কোন রাশিয়ান রেস্কিউ শিপের পাশে খুলত সাথে সাথেই রাশিয়ানরা তাদের উদ্ধারে ঝাপিয়ে পড়ত। রাশিয়ানরা এমনভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল মনে হচ্ছিল আমেরিকান না, খোদ রাশিয়ান নভোচারীরাই ফিরছে পৃথিবীতে। একই ভাবে যদি ঘটনা বিপরীত হত, আমেরিকানরাও একই ভাবে হাত বাড়িয়ে দিতো।
তাই, বিভিন্ন ধরনের ভূপৃষ্টের উপর থেকে কৃত্তিম উপগ্রহের প্রযুক্তিগত সার্ভের মাধ্যমে সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদন এবং দুনিয়াব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যের সুষম বন্টন মাত্র দুইটা উপায় যেখানে আমরা দেখতে পাই কিভাবে স্পেস প্রোগ্রাম আমাদের দুনিয়াবী সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি আমি আরো দুইটা বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই- প্রযুক্তিগত উন্নয়নের তীব্র বাসনা এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান তৈরি করা।
তীব্র স্থায়িত্ব এবং নিখুঁত চন্দ্রযান তৈরির যে মহা প্রকল্প এই ধরনের প্রজেক্ট আগে কখনো মানব সভ্যতায় দেখা যায়নি। এই কারনে এই ধরনের জটিল মহাকাশ মিশনের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি বানাতে আমাদের দরকার হল নতুন ম্যাটেরিয়াল আবিস্কার করা এবং নতুন নতুন উপায় খুজে পাওয়া। একেক টা স্পেসযান কে আরো টেকসই করবে এবং আরো নিখুঁত করবে এমন উন্নতমানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন হতে শুরু করল এবং এমনকি বিজ্ঞানের নিত্য নতুন থিউরি আর সূত্র ও আবিস্কার হতে লাগলো।
এইসব নতুন প্রযুক্তিগত আবিস্কার আমাদের দুনিয়াতে ব্যবহারের জন্যও আবিস্কার হয়েছে, শুধু মহাশূণ্যে না । প্রতিবছর হাজার হাজার আবিস্কার দুনিয়ার কোন না কোন সমস্যা সমাধান করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে যেটা আবিস্কার হয়েছিল কোন এক স্পেস প্রোগ্রামে। আমাদের আরো ভাল কিচেনের আপ্লায়েন্স, আরো ভাল ফার্মের ট্রাক্টর, আরো ভাল সুইং মেশিন, আরো ভাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিন এবং রেডিও, আরো ভাল জাহাজ এবং বিমান, আরো ভাল আবহাওয়া পূর্বাভাস, আরো ভাল যোগাযোগ , আরো ভাল চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, আরো ভাল প্রাত্যাহিক টুলস তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে এইসব আবিস্কার।
এখন তুমি প্রশ্ন করতে পারো, কেন আমাকে আগে চাঁদের নভোযাত্রীদের জন্য লাইফ সাপোর্ট আবিস্কার করতে হবে যেখানে আমরা চাইলেই দূর নিয়ন্ত্রিত হৃদপিণ্ড মনিটর আবিস্কার করতে পারি একই এফোর্ট দিয়েও। উত্তর টা একদম সোজা- দুনিয়ার কোন বিরাট প্রযুক্তিগত আবিস্কার হুট করে হয়ে যায়নি। প্রথমেই এক্টা বড় জটিল সমস্যার দিকে আমরা মনোনিবেশ করি, যেটা আমাদের কে সেটা সমাধানের জন্য ইউনিক ও নতুন কোন উপায় বের করে নিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা যোগায়। এটা অনেকটা সলতেতে আগুন দেয়ার মত, একবার স্পার্ক হলেই আমরা চেইন রিয়াকশান এর মত আগুন নিয়ে খেলতে পারব।
এই মুহুর্তে আমাদের মহাকাশযাত্রার প্রচেষ্টা একদম সেই স্পার্কের ভূমিকা পালন করছে। মংগলে অভিযান আমাদের ক্ষুধা সমস্যা নিরাপয়ের কোন সরাসরি সমাধান নয়, তবে এই প্রজেক্ট থেকে পাওয়া জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আমাদের আরো ভিন্ন রকমের সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য করবে যার মূল্যমান বর্তমান প্রজেক্টের ব্যায়ের চেয়ে শতগুণ বেশী হবে।
নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রয়োজনের পাশাপাশি আমরা যদি পৃথিবীর মানুষের অবস্থার উন্নতি করতে চাই তাহলে আমাদের দরকার নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সৃষ্টি করা। আমাদের ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, শরীরতত্ত্ববিদ্যা স্পেশালি মেডিসিনের উপর নতুন নতুন গবেষণা এবং জ্ঞান তৈরি করা দরকার যাতে আমরা দুনিয়াতে মানুষের ক্ষুধা, রোগশোক , খাদ্য ও পানি দূষণ, পরিবেশ দূষণের মত সমস্যা সমাধান করতে পারি।
আমাদের প্রচুর তরুণ-তরুণী দরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেক্টরে এবং আমাদের এই সব মেধাবী তরুণ বিজ্ঞানী যাদের মেধা ও ইচ্ছাশক্তি আছে নতুন কিছু গবেষণা করে বের করার জন্য , তাদেরকে যথাযথ সাহায্য সহযোগিতা করার ক্ষেত্র তৈরি করা উচিত। নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জিং গবেষণার সুযোগের পাশাপাশি আমাদের এই তরুণ দের গবেষনায় সর্বোচ্চ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের এই মহাকাশ যাত্রার প্রোগ্রাম চাঁদ ও গ্রহ উপগ্রহ অনুসন্ধানের মাধ্যমে একটা চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে আরো চমৎকার সব গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির ।
ফিজিক্স ও মহাকাশবিজ্ঞান, বায়োলজি ও মেডিসিনের এই সম্মিলিত গবেষণার মাধ্যমে সলতে তে আগুন দেয়ার মত একটা কাজ হয়েছে যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্পার্কের মত কাজ করবে এবং নতুন প্রাকৃতিক ঘটনা আবিস্কার বা গবেষণার সাপোর্ট পেতে সাহায্য করবে ।
আমেরিকা সরকারের অর্থায়ন, নিয়ন্ত্রন এবং পরিচালনায় যেসব বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তার মধ্যে সবচেয়ে চাক্ষুষ এবং আলোচিত- সমালোচিত প্রকল্প মহাকাশ গবেষণা যদিও তা আমেরিকায় জাতীয় বাজেটের মাত্র ১.৬% এবং GNP'র( gross national product) ১% এর ৩ ভাগের এক ভাগেরও কম। নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনুপ্রেরণা হিসেবে এবং বেসিক জ্ঞান বিজ্ঞানের গবেষণা হিসেব করলে মহাকাশ গবেষণা অন্য যেকোন ধরনের রিসার্চের আশেপাশেও নাই, যোজন যোজন এগিয়ে। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা যেখানে যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, সেখানে স্পেস প্রোগ্রাম আমাদেরকে জ্ঞান বিজ্ঞানে মত্ত থাকার একটা চমৎকার সুযোগ করে দিচ্ছে।
চিন্তা করা যায় কি পরিমান কস্ট দুর্দশা লাঘব হবে যদি আমাদের জাতিরাষ্ট্র গুলো বোমারু বিমান বহর আর যুদ্ধবিমানের বহর নিয়ে প্রতিযোগীতার পরিবর্তে সবাই মিলে চন্দ্রগামী মহাকাশযান বানানোর জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করি! এই প্রতিযোগিতা আমাদের কে চমৎকার কিছু বিজয় উপহার দিতে পারে, যেটা যুদ্ধ বিগ্রহে ভরপুর প্রতিযোগীতা কখনোই দিতে পারবেনা।
যদিও আমাদের মহাকাশ গবেষণায় মনে হচ্ছে আমাদের নজরকে পৃথিবী থেকে দূরে সরিয়ে চাঁদ, সূর্য এবং অন্য গ্রহ নক্ষত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, আসলে আমি বিশ্বাস করি এই পৃথিবী আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পাবে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও আবিস্কারের জ্ঞান আমরা দুনিয়ার উন্নতির কাজে ব্যবহার করে শুধু যে একটা আরো উন্নত দুনিয়া তৈরি করতে পারব তাই নয়, বরং একই সাথে আমাদের এই পৃথিবী, জীবন ও মানব সভ্যতা নিয়ে আরো গভীর ভাবে জানতে পারব।
এখানে আমি একটা ছবি যুক্ত করেছি। এই ছবিটি এপোলো-৮ মিশন থেকে নেয়া এটি যখন ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছিলো ১৯৬৮ সালে। এই ছবিকে স্পেস প্রোগ্রামের সর্বকালের সেরা ছবিগুলোর একটা বলে বিবেচনা করা হয়। এটি আমাদের চোখ খুলে দেয় এই সেন্সে যে, মহাশূণ্যের বিশাল শূণ্যতার মাঝে চমৎকার এবং সবচেয়ে দামী যায়গা হল আমাদের এই একমাত্র বাসযোগ্য পৃথিবী। এর আগে মানুষ এই পৃথিবীর চমৎকার সব রিসোর্স ধ্বংস করার আগে কল্পনাও করতে পারেনি আমাদের বসবাসের যায়গা কত ছোট।
এই ছবি সামনে আসার পর থেকে পুরো দুনিয়্যাব্যাপি মানুষের পরিবেশ, পানি বায়ূদূষন সহ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, খাদ্য উদপাদনের সমস্যা, পানির উপর নিয়ন্ত্রন সহ অতিরিক্ত জনসংখ্যার বিরুদ্ধে কন্ঠ সোচ্চার হয়েছে। এটা কোন এক্সিডেন্ট না যে আমরা এখন চারদিকে আমাদের পৃথিবী কে রক্ষা করার একটা জোয়ার দেখতে পাচ্ছি, এটা আমাদের মাত্র শুরু হওয়া মহাকাশ গবেষণার সরাসরি ফলাফল।
সৌভাগ্যক্রমে, বর্তমান মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে এই অগ্রগতি শুধু আমাদের সামনে পৃথিবীর একটা প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরেনা বরং এই পৃথিবীর সমস্যা গুলো সমাধান করার জন্য দরকারি প্রযুক্তি, জ্ঞান, অনুপ্রেরণা এবং চ্যালেঞ্জ সমূহ সামনে নিয়ে আসে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী Albert Schweitzer এর সাথে আমি একমত যখন তিনি বলেন- " আমি অনেক চিন্তা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তবে সেটা ভাল কিছুর আশায় " , আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞান এবং মহাকাশ যাত্রার প্রচেষ্টা থেকে প্রাপ্ত সকল জ্ঞান থেকে আমি বলতে পারি, আমিও আল্বার্টের সাথে সহমত।
তোমার এবং তোমার সন্তানের প্রতি আমার সর্বোচ্চ শুভকামনা থাকবে আজীবন।
ইতি
তোমার গুনমুগ্ধ
আর্নস্ট স্টূডলিংজ্ঞার
এসোসিয়েট ডিরেক্টর অফ সায়েন্স
মার্শাল স্পেস সায়েন্স সেন্টার , নাসা


